মুসলিম জিনের সাহায্যে চিকিৎসা জায়েজ

ভূমিকা:

আল্লাহ তাআলা মানুষ ও জ্বিন উভয় জাতিকে সৃষ্টি করেছেন তাঁর ইবাদতের জন্য (সূরা আয-যারিয়াত, ৫১:৫৬)।

এই ইবাদতের অর্থ কেবল সালাত, রোযা নয় বরং আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে অন্যের উপকার করা, সাহায্য করা ইত্যাদিও ইবাদতের অন্তর্ভুক্ত।

ইসলামে মুমিনদের মধ্যে সহযোগিতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। পবিত্র কুরআন ও সহীহ হাদীস অনুযায়ী, মুসলিমদের উচিত একে অপরের সাহায্যে এগিয়ে আসা। অনেক সময় প্রশ্ন ওঠে, “জ্বিন মুসলমান হলে কি তার সাহায্য গ্রহণ করা বৈধ হবে?” আমরা আলোচনা করব, শরীয়তের আলোকে মুসলিম জ্বিনদের সহযোগিতা গ্রহণের বৈধতা কতটুকু।

কুরআন ও হাদীসে সহযোগিতার নির্দেশনা:

আল্লাহ বলেন:

“তারা আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধ করে এবং একে অপরকে সাহায্য করে।” — সূরা আনফাল ৮:৭৪

আল্লাহ আরও বলেন:

“তোমরা সৎকর্ম ও তাকওয়ার বিষয়ে পরস্পরের সহায়তা করো, কিন্তু গোনাহ ও সীমালঙ্ঘনের বিষয়ে নয়।” — সূরা মায়েদা ৫:২

রাসূলুল্লাহ বলেছেন:

“যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের প্রয়োজন পূরণ করবে, আল্লাহ তার প্রয়োজন পূরণ করবেন।” — সহীহ বুখারী: ৬৯৫১

এছাড়াও; “বান্দা যতক্ষণ তার ভাইয়ের সহযোগিতায় আত্মনিয়োগ করে, আল্লাহ ততক্ষণ তার সহযোগিতা করতে থাকেন।” — সহীহ মুসলিম: ৬৭৪৬

এখানে “ভাই” বলতে শুধুমাত্র মানুষ বোঝানো হয়নি। কারণ ঈমানের সম্পর্ক রক্তের সম্পর্কের চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

নিশ্চয়ই মুমিনগণ পরস্পরের ভাই।” — সূরা হুজুরাত ৪৯:১০

মুমিন জ্বিনও এই আয়াতের আওতায় পড়ে, কারণ কুরআন ও দ্বীন ইসলাম জ্বিন ও ইনসান উভয়ের জন্য এসেছে। পবিত্র কোরআনের একাধিক স্থানে বলা হয়েছে, , ‘আমি অবশ্যই জিন ও মানুষ উভয়ের মাধ্যমে জাহান্নামকে পূর্ণ করব।’—- সুরা হুদ, ১১:১১৯

রাসূল ﷺ বলেছেন: “তোমরা শুকনো গোবর ও হাড় দ্বারা ইস্তিনজা করো না, কেননা এগুলো তোমাদের ভাই জ্বিনদের খাদ্য।” — তিরমিজি: ১৮, মিশকাত: ৩৫০

এখানে স্পষ্টভাবে মুসলিম জ্বিনদের “ভাই” বলা হয়েছে। সুতরাং ভাই হিসেবে যতটুকু সহযোগিতা নেওয়া বৈধ, তা গ্রহণে বাধা নেই। তবে, জ্বিন ও শয়তানের মধ্যে কিছু পার্থক্য আছে।

জ্বিন ও শয়তানের পার্থক্য: পরিচয় ও সৃষ্টি

জ্বিন

  • জ্বিন আল্লাহর সৃষ্টি, অদৃশ্য প্রাণী, যারা আগুন থেকে সৃষ্টি।
  • কোরআনে বলা হয়েছে:
    “আমি জ্বিনকে সৃষ্টি করেছি আগুনের অগ্নি থেকে।”— সূরা আর-রহমান ৫৫:১৫
  • জ্বিনদেরও মানবদের মতো স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি আছে, তারা ঈমানদার বা কাফের হতে পারে।
  • সূরা আল-জিন (সূরা ৭২) সম্পূর্ণই জ্বিনদের ব্যাপারে, যেখানে তাদের ঈমান আনার কথা বর্ণিত হয়েছে।

শয়তান

  • অপচয়কারীরা শয়তানের ভাই— (সুরা বনি ইসরাঈল: ২৭)
  • “শয়তান” শব্দের অর্থ হলো ‘বিপথগামী’ বা ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’।
  • শয়তান হলো সেই সত্তা যারা আল্লাহর আদেশ থেকে অবাধ্য এবং মানুষ ও অন্য সৃষ্টিকে গোমরাহ করার চেষ্টা করে।
  • সবচেয়ে বড় শয়তান হল ইবলিস, যে আদম (আ.)-কে সিজদা না করে বিদ্রোহ করেছিলো:
    “আমি আগুন থেকে সৃষ্টি, আর তুমি মাটি থেকে সৃষ্টি।” — (সূরা আল-আরাফ, আয়াত ১২)
  • শয়তান মূলত একজন জ্বিন, কিন্তু সব শয়তান জ্বিন নয়, কারণ মানুষের মধ্যেও শয়তান বা পথভ্রষ্টকারী হতে পারে।

মুমিন জ্বিনের অবস্থান:

১. জ্বিনদের ঈমান গ্রহণ ও দাওয়াতি কাজ: তারা (জ্বিনরা) বলল, হে আমাদের সম্প্রদায়! তোমরা আল্লাহর দিকে আহ্বানকারী একজনকে (নবী মুহাম্মদ) গ্রহণ করো এবং তাঁর প্রতি ঈমান আনো” — সূরা আহ্‌কাফ, ৪৬:২৯–৩২

এই আয়াতে বোঝা যায়, মুমিন জ্বিনরাও দ্বীন প্রচারে কাজ করে থাকে।

২. রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর ক্বারীন সম্পর্কে হাদীস: “আমার ক্বারীনকে আল্লাহ বশীভূত করেছেন, সে আমাকে শুধু ভালো কিছুই বলে।” — সহীহ মুসলিম: ২৮১৪

এতে প্রমাণিত হয়, জ্বিন আল্লাহর ইচ্ছায় নেক কাজে সহায়তা করতে পারে। এবং সত্য কথাও বলে।

অনেকে প্রশ্ন করেন; আমরা কেন সহযোগিতা চাইবো? বৈধ সহযোগিতা নেয়া চাওয়া অবশ্যই জায়েজ আছে।

সাহাবিগণ সহযোগিতা চেয়েছেন:

১. হযরত আলী (রা.) বলেন:

“আমরা এতটাই কষ্টে ছিলাম যে কখনো আমি শ্রম করতাম, কখনো ধার করতাম খাবারের জন্য।”

২. রাসূল নিজেও ঋণ নিয়েছেন:

“রাসূলুল্লাহ ﷺ একজন ইহুদির নিকট খাদ্যশস্যের বিনিময়ে কিছু দ্রব্য ধার (ঋণ) নিয়েছিলেন।” — সহীহ বুখারি: ২২০০

এই উদাহরণগুলো থেকে বোঝা যায়, প্রয়োজনে সহায়তা চাওয়া এবং গ্রহণ করা শরিয়তের দৃষ্টিতে বৈধ — যদি তা হারাম পন্থায় না হয়।

ফিকহ ও উসূলের আলোকে বিশ্লেষণ:

১. সাহায্য ইবাদতের অন্তর্ভুক্ত: “তোমরা সৎকর্ম ও তাকওয়ার বিষয়ে একে অপরকে সহযোগিতা করো।” — (সূরা আল-মায়েদাহ ৫:২ )

এই আয়াতে সাহায্যকে সৎকর্ম বা ইবাদতের অন্তর্ভুক্ত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

২. ইবন তাইমিয়্যার মতামত: “জ্বিন যদি শরিয়তসিদ্ধ উপায়ে মানুষকে সাহায্য করে এবং কুফরি বা শিরকে জড়িত না হয়, তবে তা বৈধ হতে পারে।” —( *Majmoo’ al-Fataawa*, খণ্ড ১১, পৃষ্ঠা ৩০৭ )

৩. মাকাসিদ ash-Shari’ah (শরিয়তের উদ্দেশ্য):** শরিয়তের অন্যতম উদ্দেশ্য হলো মানুষের কল্যাণ সাধন ও অনিষ্ট দূরীকরণ। অতএব, মুমিন জ্বিনের মাধ্যমে উপকার গ্রহণ যদি এই উদ্দেশ্যের পরিপন্থী না হয়, তবে তা শরিয়তসম্মত হতে পারে।

জ্বিনদের সহযোগিতা প্রসঙ্গে সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা:

  • কুরআনে বহুবার বলা হয়েছে, আল্লাহ আসমান-জমিনের সব কিছু মানুষদের উপকারের জন্য নিয়োজিত করেছেন:

“তিনিই তোমাদের জন্য যা কিছু আকাশে ও পৃথিবীতে আছে, সবই তাঁর পক্ষ থেকে নিয়োজিত করেছেন।” — সূরা জাসিয়া ৪৫:১৩

  • পশু, নদী, সাগর, ফলমূল, ইত্যাদি মানুষদের জন্য সেবা দেয়।

তাহলে মুমিন জ্বিন যদি স্বেচ্ছায় হালাল পন্থায় সাহায্য করে, তা অস্বীকার করার কারণ কী?

সীমারেখা:

**শুধু আল্লাহর জন্য নির্ধারিত বিষয়ে যেমন ইলমে গায়েব, ইবাদতের ধরনে সাহায্য চাওয়া বা শিরকীয় কিছু— এসব ক্ষেত্রে জ্বিন তো দূরে থাক, কোনো মানুষের সাহায্যও বৈধ নয়।

**কোনো হারাম বা কুফরি পন্থা অবলম্বন না করা।

 **মুমিন জ্বিন কর্তৃক আল্লাহর সন্তুষ্টির নিয়ত থাকা।

 **সহযোগিতা হতে হবে শরিয়তের পরিপন্থী কাজ ছাড়া।

**জ্বিনের উপর নির্ভরশীলতা তৈরি না হওয়া, বরং তাওয়াক্কুল (আল্লাহর উপর ভরসা) বজায় রাখা।

সর্বপোরি:

মুমিন জ্বিন আমাদের ঈমানি ভাই। কুরআন ও হাদীসের নির্দেশনা অনুযায়ী পরস্পরের সহযোগিতা করা গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। সুতরাং, যদি মুমিন জ্বিন হালালভাবে, শরয়ি সীমার মধ্যে থেকে কোনো প্রয়োজনে সাহায্য করে, তা গ্রহণে বাধা নেই। বরং এটা ইসলামের সেই মৌলিক চেতনার প্রতিফলন— ভাই ভাইয়ের পাশে থাকবে।

কিছু ভুল ধারণা:

জ্বিনের সাহায্য নিলে তাদের অহংকার বেরে যাবে: আর নিশ্চয় কতিপয় মানুষ কতিপয় জিনের আশ্রয় নিত, ফলে তারা তাদের অহংকার বাড়িয়ে দিয়েছিল। (সুরা জ্বিন ৭২:৬)

এ আয়াতের আলোকে অনেকে জ্বিনের সহযোগিতা নেয়া হারাম বলেছেন। অথচ আশ্রয় চাওয়া আর সহযোগিতা চাওয়া এক বিষয় নয়। অনেকে গরুর নিকট মঙ্গল কামনা করেন আবার অনেকে গরুর সহযোগিতা নিয়ে বিভিন্ন কাজ করে থাকে।

জ্বিন আটকানো যায়না: অনেকে বলেন জ্বিন বা শয়তানকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়না বরং তারাই মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করে। অথচ কুরআন ও হাদিস থেকে পাওয়া যায় জ্বিন আটকানো ও নিয়ন্ত্রণ করা যায় ।

জ্বিনদের শুধু সুলাইমান (আ:) এর অধীনস্থ করেছেন বিষয়টা এমন নয়। একবার একটি অবাধ্য  জ্বিন এক রাতে রাসূল (স:) এর সালাতে বাধা সৃষ্টি করছিলো। রাসূল (স:) তাকে ধরলেন এবং মসজিদের একটি খুঁটির সাথে বেঁধে রাখার ইচ্ছে করলেন, যাতে সবাই স্বচক্ষে দেখতে পায়। তখনই সুলাইমান (‘আঃ)-এর এ দু’আ মনে পড়লো। অতঃপর রাসূল (স:) জ্বিনটিকে ব্যর্থ এবং লাঞ্ছিত করে ছেড়ে দিলেন। (সহিহ বুখারী : ৩৪২৩)

এছাড়াও আবূ হুরায়রা (রাঃ) রমযানের যাকাত হিফাযত করার দায়িত্বে ছিলেন। তখন শয়তান এসে অঞ্জলি ভর্তি করে খাদ্য সামগ্রী নিতে লাগল। তখন তিনি শয়তানকে ধরে পাকড়াও করে ফেলেন। (সহিহ বুখারি: ২৩১১)

এ থেকে বুঝা যায় জ্বিন ও শয়তানদের পাকড়াও করা এবং তাদের লাঞ্ছিত করা যায়।

মুদাব্বির সিহাব (কুষ্টিয়া)

Ruqya BD ✅ রুহানি চিকিৎসা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Main Menu